নিহতদের ফিরে আসায় স্বীকারোক্তি ও পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন

https://ift.tt/eA8V8J
নারায়ণগঞ্জ, ৩ অক্টোবর- গত ৪০ দিনে দুইজন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার বা তাদের ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে। আর দেড় বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তিনটি। এর মধ্যে একজনকে হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলা, একজনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং আরেকজনকে বিষাক্ত শরবত পান করিয়ে হত্যার পর শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কথিত অপরাধীদের পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। কিন্তু মৃত সেই তিনজনই বাড়ি ফিরে এসেছেন জীবিত। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, হত্যায় জড়িত না থেকেও কোনো ব্যক্তি কেন, কিভাবে আদালতে বলেন, আমিই হত্যাকারী। এই স্বীকারোক্তির কারণ কী? ভুক্তভোগীদের পরিবার বলছে, গ্রেপ্তারের পর নিষ্ঠুর নির্যাতন, কখনো বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়। এ কারণে ঘটনায় জড়িত না থেকেও অনেকে দায় স্বীকার করেন। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন জোরালো হয়ে ওঠে। সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্টও। নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলছাত্রী নিখোঁজ হয় গত ৪ জুলাই। এক মাস পর ৬ আগস্ট তার বাবা সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার পরদিন পুলিশ তিন আসামি যথাক্রমে স্কুলছাত্রীর কথিত প্রেমিক আব্দুল্লাহ, অটোচালক রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে ৯ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। অথচ ২৩ আগস্ট ওই কিশোরী জীবিত ফিরে আসে। এর ফলে পুলিশের তদন্ত ও আদালতে দেওয়া আসামিদের জবানবন্দি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াসহ তাঁকে থানা থেকে ক্লোজ (প্রত্যাহার) করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে বিষয়টি উচ্চ আদালতেরও নজরে আসে। ওই ছাত্রীর পরিবার, পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, নতুন প্রেমিকের কাছে ভালো আচরণ না পেয়ে ওই ছাত্রী আগের প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছিল। তারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ বন্দরের নবীগঞ্জ কুশিয়ারা এলাকায় রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিল। একসময় অর্থসংকটে পড়ে মেয়েটি তার পরিবারের কাছে চার হাজার টাকা চেয়ে দোকানির মোবাইল থেকে ফোন করে। এরপর পুলিশের সহায়তা নিয়ে ওই রাতেই উদ্ধার করা হয় সেই ছাত্রীকে। এই নারায়ণগঞ্জেই আরেক মৃত ব্যক্তির ফিরে আসার ঘটনা ঘটে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। অপহরণ করে হত্যার অভিযোগ ওঠার ছয় বছর পর নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির হন মামুন নামের ওই ব্যক্তি। অথচ তাঁকে হত্যার অভিযোগে গার্মেন্টকর্মী তাসলিমাকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। তাঁর বাবা, ভাইসহ আরো তিনজনও ছিলেন জেলহাজতে। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মিজান তাসলিমা ও তাঁর বাবাসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, মামুনকে বিষাক্ত শরবত পান করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে তাঁর লাশ গুম করা হয়েছে। আসামিরা সে সময় রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েও দোষ স্বীকার করেননি। পরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হলে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ তদন্ত করেন। তিনি গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর চার্জশিটে এ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে বলেন, মামুনকে চেতনানাশক পানীয় পান করিয়ে অপহরণ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে কোথায় কী অবস্থায় রাখা হয়েছে সেটা জানা যায়নি। গত বুধবার সেই মামুন আদালতে হাজির হন। মামুন জানান, মা-বাবা কাজের কথা বলায় তাঁদের সঙ্গে অভিমান করে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর ছেড়ে চলে যান তিনি। ছয় বছর রাজশাহী ও নাটোরে অবস্থান করে হোটেলসহ নানা ধরনের ছোটখাটো কাজ করেছেন। এ ছাড়া আরো কয়েকটি জেলার গ্রামগঞ্জে থেকে দিনমজুরের কাজও করেছেন। এ মামলার এজাহার থেকে চার্জশিট পর্যন্ত পুলিশ ও সিআইডির যে আটজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তাঁদের সাত কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত প্রতিবেদনসহ হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফতাবুজ্জামানের আদালত এই নির্দেশ দেন। নারায়ণগঞ্জ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের হালিশহর থানায় হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলা একটি মরদেহ উদ্ধারের পর দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত বছরের ৪ এপ্রিলের এ ঘটনার পর গ্রেপ্তার দুই কিশোরের মধ্যে একজনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও আদায় করা হয়। তাতে বলা হয়, নিহত ব্যক্তি হচ্ছেন দিলীপ রায়। আদালতে ১৬৪ ধারায় ওই জবানবন্দির সত্যতা নিশ্চিত করতে গিয়ে পুলিশই পরে উদ্ধার করে কথিত নিহত ব্যক্তি দিলীপ রায়কে। তাঁকে গত বছরের ২ মে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করে, কথিত নিহত ব্যক্তি দিলীপ রায় মারা যাননি। তিনি জীবিত আছেন। কথিত দিলীপ রায় যদি মারা না যান, তাহলে কিশোর জীবন চক্রবর্তী খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিল কিভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর নেই পুলিশের কাছে। ওই সময় মামলাটি তদন্ত করছিলেন হালিশহর থানায় কর্মরত উপপরিদর্শক মো. সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, একটি সিমের প্যাকেটে পাওয়া মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে জীবন চক্রবর্তী ও দুর্জয় আচার্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে জীবন চক্রবর্তী জানিয়েছিল, গাঁজা খাওয়া ও ৫০ টাকার জন্য সৃষ্ট বিরোধকে কেন্দ্র করে দীলিপ রায়কে খুনের পর পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। জীবন চক্রবর্তীর স্বীকারোক্তির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে পুলিশই পরবর্তী সময়ে উদ্ধার করে কথিত নিহত ব্যক্তি দিলীপ রায়কে। এ ধরনের বহু অসত্য স্বীকারোক্তির ঘটনা ক্রসফায়ারের হুমকি ও নির্যাতনের কারণেই ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন দুর্জয় আচার্যের মা সন্ধ্যা আচার্য এবং জীবন চক্রবর্তীর বাবা সুমন চক্রবর্তীও। শুধু এ তিনটি ঘটনাই নয়, এ রকম অনেক মামলা রয়েছে, যেখানে ঘটনায় জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলার তদন্তে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যের গাফিলতি এবং অন্য উদ্দেশ্যে প্রভাব খাটানোর কারণে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাদী, আসামিসব পক্ষই। আরেক দিকে মূল অপরাধীরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আরও পড়ুন:আমার গর্ভের নষ্ট হওয়া সন্তান কী ফিরে আসবে? পুলিশের নির্যাতনে সিদ্ধেশ্বরীর রুবেল নিহত হওয়ার ঘটনায় করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট রিমান্ড ও আসামি গ্রেপ্তার নিয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। ২০১৬ সালে ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারা অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যাতে বাইরে থেকে তার আইনজীবী দেখতে পারেন যে আসামির ওপর নির্যাতন হচ্ছে না। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন হলে তা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে এলেই মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেবেন। কিন্তু এসবের অনেক কিছুই মানা হয় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও মোহাম্মদ শিশির মনিরসহ আইন বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে চললে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়সংক্রান্ত ১৬৪ ও ৩৬৪ ধারায় সামান্য পরিবর্তন আনলেই মামলার তদন্ত আরো স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে জবানবন্দি রেকর্ড পদ্ধতিতে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের বিধান যুক্ত করতে হবে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ওই সময়ের অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং থাকলে তখন আর এই নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ তুলতে পারবে না কেউ। সূত্র: কালের কন্ঠ আর/০৮:১৪/০৩ অক্টোবর
https://ift.tt/3irkVrV

Post a Comment

0 Comments