বিক্রি হয়ে যাচ্ছে স্কুল!

https://ift.tt/eA8V8J
ঢাকা, ০৫ জুলাই- রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন সড়কে কম্পিউটার কম্পোজ করা সাদা কাগজের একটি বিজ্ঞাপন দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে। বিজ্ঞাপনের ভাষাটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। তাতে লেখা- ফার্নিচারসহ স্কুল বিক্রি হবে। ফোন করুন- ...। এই প্রতিবেদক ফোন করে বিজ্ঞাপনদাতার নাম-পরিচয় বিস্তারিত জানতে পারেন। পরে দেখা হয় তার সঙ্গে। ভদ্রলোকের নাম তকবীর আহমেদ। তিনি মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধের ঢাকা উদ্যান এলাকার নবীনগর হাউজিং ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তিনি শিশুদের এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। করোনাকালে বিদ্যালয়ের টিউশন ফিসহ সব রকম আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়ে তিনি বিদ্যালয়টি এখন বিক্রি করে দিতে চান। জানা গেল, তকবীর আহমেদ এক মাস ধরে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন অলিগলিতে তার স্কুলটি বিক্রির বিজ্ঞাপন সংবলিত পোস্টার নিজ হাতে সেঁটে চলেছেন। চোখে অশ্রু নিয়ে তকবীর আহমেদ বলেন, স্কুল বিক্রি না করলে চলব কী করে? চার মাস ধরে স্কুলের কোনো আয় নেই। প্রতি মাসে ভবনের ভাড়া দিতে হয় ৪৬ হাজার টাকা। ৫০ হাজার টাকা আছে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন। আছে আরও অন্যান্য খরচ। মার্চ মাস থেকে বাচ্চারা (ছাত্রছাত্রী) কোনো টাকা-পয়সা দিচ্ছে না। হতাশ কণ্ঠে বলেন, বিজ্ঞাপন দিয়েও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে তিলে তিলে তিনি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আড়াইশ শিক্ষার্থী রয়েছে। ১২ জন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী রয়েছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ, বাসাবাড়িতে যাদের বাবা-মা কাজ করে, গার্মেন্ট শ্রমিক, সিএনজি অটোর ড্রাইভার, ট্যানারি শ্রমিকের সন্তানরা তার বিদ্যালয়ে পড়ে। তারা কোনোভাবেই করোনাকালে টিউশন ফি দিতে রাজি নয়। ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, পড়ে আছে স্কুলের শূন্য আঙিনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা তারা বিক্রি করে দেবে। কিছু তো করার নেই। সবকিছু ছেড়ে হয়তো পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যেতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেল, করোনার কারণে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর শান্তিবাগে অবস্থিত ঢাকা ক্যাডেট স্কুলও। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজধানী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন নিজ গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। মুঠোফোনে তিনি বলেন, আয় না থাকলে স্কুল চলবে কী করে? করোনার কারণেই বাধ্য হয়ে স্কুলটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এ বিদ্যালয়ের মতোই স্কুল বিক্রি করে দিতে চায় রাজধানীর রামপুরার ৪৫/১/৩, বাগিচারটেকে অবস্থিত ইকরা আইডিয়াল স্কুল কর্তৃপক্ষও। তবে তারা এ নিয়ে কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে দিতে রাজি নয়। রাজধানীর মিরপুর ও শাহআলী এলাকার আরও দুটি স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর মিলেছে। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মিরপুর কাজীপাড়ার শাইনিং স্টার স্কুলও। প্রতিষ্ঠানটির মালিক হেলাল উদ্দিন তার পরিচিতজনের কাছে সে কথা জানিয়েছেও। তবে যোগাযোগ করা হলে সমকালের পরিচয় পেয়ে হেলাল উদ্দিনের স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রিন্সিপাল জানান, তারা বিক্রি করবেন না। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে বেকার হয়ে পড়বেন প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকারের আর্থিক সহায়তা না পেলে এই ১০ লাখ পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়বে। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মো. রেজাউল হক বলেন, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন এবং সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক কোটিরও বেশি শিশু শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়াও ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে তাদের পরিবারবর্গ। এ বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার আহার জোগানো এখন কষ্ট। করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য ১৬ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সবাই। কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকা লকডাউনের কারণে প্রাইভেট টিউশনও করতে পারছে না এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় না থাকায় বেতনও পাচ্ছেন না। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া বাড়িতে। মাসের প্রথমেই পরিশোধ করতে হয় বাড়িভাড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের বেতন, অন্যান্য বিলসহ বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ ও পানির বিল। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে প্রতিষ্ঠাতারা বাড়িভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন কোনো কিছুই পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি বলেন, একদিকে বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়ার চাপ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের চাপ এবং তাদের পরিবারেরও অর্থকষ্ট, পর পর দুটি ঈদ- সব মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোয়ারা ভূঁইয়া বলেন, এসব স্কুলশিক্ষক অতীতে কখনও সরকারের কাছে বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেননি। এ স্কুলগুলো যদি না থাকত তাহলে সরকারকে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতি মাসে শিক্ষক বেতন বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। সেদিক থেকে বলা চলে আমরা সরকারের বিরাট রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ চাহিদা এ স্কুলগুলো পূরণ করে থাকে। কোনো কারণে শিক্ষা ব্যাহত হলে প্রাথমিক শিক্ষাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বেসরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে যারা পড়াশোনা করে তাদের অধিকাংশ অভিভাবক নিম্ন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ আয়ের লোক। এ দুর্যোগে পড়ে তাদের অনেকেই সংসার চালাতেই অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এম এন / ০৫ জুলাই
https://ift.tt/2ZRSTPl

Post a Comment

0 Comments