https://ift.tt/eA8V8J
ঢাকা, ০৫ জুলাই- করোনা মহামারি সংকটে গণপরিবহনে উভয় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ধিত ভাড়া দিয়ে রাজধানীতে গণপরিবহন পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এ ছাড়া বাস সার্ভিসের পাশাপাশি ঢাকায় রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চলাচলও স্বাভাবিক হয়নি। অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চললেও ঢাকা বরাবরেই মতোই ট্যাক্সিক্যাববিহীন। ফলে এ সময়ে জরুরি পরিবহন সেবা পেতেও সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের দাবি, অন্তত উবার-পাঠাওয়ের প্রাইভেট কার সার্ভিস স্বাভাবিক করে দেওয়া হোক। তাহলেও মানুষ রাজধানীতে চলাচলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় যাত্রী পরিবহন করতে না পারায় ভাড়া বাড়ানোর পরও বাস মালিকদের আয় কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। বিশেষ করে দূরপাল্লার বাসগুলো প্রায় যাত্রীশূন্য। ফলে ব্যাংকের কিস্তি দিয়ে অনেক মালিকেরই গাড়ি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা চাচ্ছেন গাড়ি বন্ধ করে দেবেন। এই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন গণপরিবহনের শ্রমিকরা। শ্রমিকদের নাম ভাঙানো পরিবহন শ্রমিক সংগঠন থাকলেও তাদের পাশে কেউ নেই। বিপুলসংখ্যক পরিবহন শ্রমিক ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। বিশেষ করে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ও পানির বিলের কারণে তাদের পক্ষে মেস বা অন্য ভাড়া বাড়িতে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যারা এখনও কাজ করছেন, তারাও এক বেলা খেয়ে-না খেয়ে নিদারুণ কষ্টেই দিন পার করছেন। পরিবহন নেতারা বলছেন, গণপরিবহনে এতটা সংকটজনক অবস্থা আর কখনও হয়নি। সকালে, দুপুরে, বিকেলে পৃথক চিত্র: রাজধানীতে সরেজমিন দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টায় গণপরিবহনের জন্য মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায় উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায়। যাত্রীরা জানান, আগে সমস্যা ছিল বাস পাওয়া নিয়ে। এখন মহামারির সময়ে বাস আরও কম। আগে বাসে ঠেলেঠুলে উঠেও যাওয়া যেত। কিন্তু এখন স্বাস্থ্যবিধির কারণে অধিকাংশ বাসই সিটের বেশি যাত্রী নিচ্ছে না। বিমানবন্দর এলাকায় ৩০টি আসনের মিনিবাসে ৪৫ আসন বসানো এবং তাতে পেছনের পুরোপুরি সিট পূর্ণ দেখা যায় ভিক্টর পরিবহনের বাসে। বাসের চালকের সহকারী হামিদ জানান, যাত্রীরা এ সময়ে জোর করেই ওঠেন। অন্য সময়ে তারা অর্ধেক সিট খালি রাখে, সকালে অফিস সময়ে সেটা যাত্রীদের কারণেই সম্ভব হয় না। এ সময় যাত্রীদের দুজন জানান, সিট আছে বলেই তাদের তোলা হয়েছে। ওঠার পর দেখেন অর্ধেক সিট খালি তো নয়ই, দু-তিনটি মাত্র সিট ফাঁকা। বাসে উঠে নেমে গেলে এ সময় আর বাস পাওয়াও মুশকিল। এ কারণে তাদের যেতেই হচ্ছে। আর একজন যাত্রী প্রশ্ন রাখেন, যাত্রী অনুপাতে তো বাসই নেই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তো ১২টার সময়ও অফিস যাওয়া যাবে না! উবার-টুবারও তো পাওয়া যায় না। দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর অধিকাংশ বাসই ফাঁকা দেখা যায়। এ সময় ঢাকার রাস্তায় মানুষের সমাগমও কম। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন বলেই অফিস সময়ের পর যাত্রী একেবারেই কমে যাচ্ছে বলে জানান পরিবহন সংশ্নিষ্টরা। তবে বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত আবারও রাস্তার মোড়ে মোড়ে সকালের মতোই যাত্রীর ভিড় দেখা যায়। যাত্রী সংকটে দূরপাল্লার বাস: সকাল ১০টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে কাউন্টারের সামনে দিয়ে গেলেই হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। অর্ধেক খালিতে সিট আছে। গাড়ি স্যানিটাইজ করা। দু-একজন কাছাকাছি চলে আসেন। যাবেন কই? অথচ এই টার্মিনালে কিছুদিন আগেও বাসের জন্য যুদ্ধ করতে দেখা যেত যাত্রীদের। একটু ভালো পরিবহনের বাস হলে কাউন্টারের কর্তব্যরতরা চোখমুখ কুঁচকে রাশভারী সাজার চেষ্টা করে যাত্রীদের দিকে তাকাতেন। করোনা মহামারি সেই চিত্র বদলে দিয়েছে। প্রথমত, অনেক বাসের টিকিট এখন পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। আবার জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ দূরের ভ্রমণ করছেন না। ফলে কাউন্টারগুলো এখন যাত্রীর মন তুষ্ট করতে ব্যস্ত। একই চিত্র দেখা গেল রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালেও। এ টার্মিনাল থেকে সাধারণত আগাম টিকিট দেওয়া হয় না। যাত্রীদের সশরীরে এসে টিকিট কাটতে হয়। ফলে এই টার্মিনালে যাত্রীর ভিড় সব সময় থাকত। সেই টার্মিনাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখা গেল একেবারেই ফাঁকা। এখানে একটি বাসের কর্তব্যরত কাউন্টার কর্মকর্তা আতিক জানালেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। যাত্রী একেবারেই হাতেগোনা। একটা ট্রিপে তেল খরচের টাকাও ওঠে না। বাস চালানো, না চালানো এখন সমান কথা। মালিকদের পোষায় না, কষ্টে আছেন শ্রমিকরা: রাজধানীর একটি লোকাল বাসের কন্ডাক্টর সাগর মিয়া। ময়মনসিংহের শেরপুরে বাড়ি। ঢাকায় পালা করে লোকাল বাসে কাজ করতেন। বলাকা, তিন নম্বর, আজমেরী, অনাবিল প্রায় সার্ভিসেই কাজ করেছেন তিনি। করোনা মহামারিতে গণপরিবহন বন্ধ হলে সে গত এপ্রিলের শুরুতেই বাড়ি চলে গিয়েছিল। খুব কষ্ট করে দিন কেটেছে। বাড়িতে থাকার সময় আগের জমানো সামান্য টাকা শেষ হয়ে গেছে। ঈদের পর আবার ঢাকায় আসে। ঢাকায় আসার পর গাড়ি চালু হলো, কিন্তু তার ভাষায় ইনকাম নাই। আগে যেখানে দিনে হাতে মিনিমাম পাঁচশ টাকা থাকত, কোনো কোনো দিন হাজার টাকাও থাকত, এখন দিনে ডিউটি করে আড়াইশ টাকাও হাতে থাকে না। তার ওপর মহাখালীতে যে মেসে থাকত সেখানে ভাড়া বাড়েনি, কিন্তু আগে যেখানে বিল আসত তিনশ থেকে চারশ টাকা, এখন আসছে হাজার টাকার বেশি। একজনের ঘাড়েই দুইশ টাকা পড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লা বলেন, গণপরিবহনে এমন অবস্থা এর আগে হয়নি। সবাই দেখছে ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু যাত্রী সংকটে সার্ভিস চালু রাখাই এখন বড় কষ্ট। রাজধানীর ভেতরে অফিস টাইমে যাত্রী হয়, তারপরও স্বাস্থ্যবিধির কারণে অর্ধেক যাত্রী নিতে হয়। আর দূরপাল্লার বাসে তো যাত্রী নাই বললেই চলে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এক ট্রিপ চালাতে সব মিলিয়ে যে খরচ হয়, যাত্রী না পাওয়ার কারণে ভাড়া বাড়ার পরও তার অর্ধেক খরচও ওঠে না বেশিরভাগ ট্রিপেই। আবার তেলের দাম, গ্যাসের দাম কিছুই কমেনি, যন্ত্রাংশের দামও আগের মতোই, ব্যাংকের কিস্তি দিতে হচ্ছে সময়মতো। যেভাবে চলছে, তাতে আর কয়েকদিনের মধ্যে অধিকাংশ বাস চালানো সম্ভব হবে না। এখন মালিকরা তিন ভাগের একভাগ বাস চালাচ্ছেন। এভাবে চললে শতভাগ বাসই বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা খুব কষ্টে আছে, এটা ঠিক, কিন্তু মালিকরা আয় করতে না পারলে স্টাফদের বেতনও দিতে পারবে না। তিনি গণপরিবহন খাতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। পরিবহন শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দাবিদার সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এবার বড় সংকটের সময় শ্রমিকদের পাশে দেখা যায়নি, এমন সমালোচনায় গত দু-তিন মাস ধরেই সংগঠনের নেতারা কঠোর সমালোচনার মুখে আছেন। গতকাল রোববার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এ ব্যাপারে বলেন, শ্রমিকদের পাশে ফেডারেশন নাই, এমন সমালেচনা যারা করেন, তারা না জেনে করেন। ফেডারেশনের ২২৫টি অধিভুক্ত ইউনিয়ন থেকে সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের কয়েক কোটি টাকার ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ লাখ শ্রমিককে জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার জন্য একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। এম এন / ০৫ জুলাই
https://ift.tt/31HpQ3r
0 Comments