https://ift.tt/eA8V8J
ঢাকা, ২৫ আগস্ট - সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কমিশনারদের পদমর্যাদা নির্ধারণ করা আছে আইনে। সেখানে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সমমর্যাদার অধিকারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং হাইকোর্টের বিচারপতির সমতুল্য নির্বাচন কমিশনাররা। বেতন সুযোগ-সুবিধাতে তফাৎ নেই। বিচার বিভাগে কর্মরতদের সুবিধা বাড়লে কমিশনের সাংবিধানিক পদধারীদের অটো এ সুবিধা যুক্ত হয়ে যায়। চিকিৎসা সুবিধার ক্ষেত্রে নেই কোনো বৈষম্য। সব সুবিধার পরও কেন অবসরের পর বিচারপতিদের সমান প্রাধিকার চান সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা, এ প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে কী কারণে নতুন করে প্রাধিকারের দাবিতে সোচ্চার কমিশনাররা, তা নির্ধারণে গঠন করা হয়েছে ইসির একজন যুগ্মসচিবকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের সাব-কমিটি। গত ১৯ আগস্ট গঠিত কমিটি ৫টি বিষয়কে (সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের সম্মানী, সুযোগ-সুবিধা, ছুটি, পেনশন ও প্রাধিকার) অগ্রাধিকার দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। কমিটি গঠন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের প্রাধিকার-সংক্রান্ত আইন-প্রণয়নের যৌক্তিক দিকগুলো প্রস্তাব আকারে এনে নির্বাচনী আইন সংস্কার কমিটিতে উত্থাপন করবে। শিগগিরই এ কমিটি প্রাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মপরিধির মধ্যে কী সংযোজন-বিয়োজন করা যায়, তা নির্ণয়ে বৈঠক বসবে। সূত্র বলছে, বিচারপতিদের প্রাধিকার অ্যাক্টের আলোকে সাংবিধানিক পদধারী ইসি কমিশনারদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ হয়ে আসছে। কিন্তু স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সিইসি ও কমিশনাররা খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে নিয়োগ পান। বিচারপতিদের প্রাধিকার অ্যাক্ট থেকে কমিশনাররা কেন আলাদা হতে চান, এর নেপথ্যের কারণ পেনশন, সুযোগ-সুবিধা, ছুটি ও সম্মানী বিষয়ে সরাসরি সরকারের কাছে তাদের যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত করা। এর জন্য সাংবিধানিক পদধারী ইসি কমিশনাররা প্রাধিকার অ্যাক্ট প্রণয়নের জন্য তৈরি করেছে একটি প্রস্তাবনা। এই খসড়া নিয়ে সাব-কমিটি আলোচনায় বসবে। তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রাধিকার অ্যাক্ট হওয়া ইসির জন্য ততটা যৌক্তিক নয়। কারণ কর্মজীবনের পর সমাজের সবচেয়ে যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন নাগরিকদের বাছাই করে কমিশনার পদে মনোনীতি করেন রাষ্ট্রপতি। থাকেন মাত্র পাঁচ বছর। এই বয়সে সরকার কিংবা রাষ্ট্র তাদের যে সম্মানিত করছেন, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। এরপর তাদের পেনশন সুবিধা, ছুটি ও সম্মানীর জন্য স্বতন্ত্র প্রাধিকার আইন করা সমীচীন হবে না। কারণ একজন চাকরিজীবী তার সারাটা জীবন সরকারকে সার্ভিস দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবসরকালীন পেনশন সুবিধা দেন তার মর্যাদার অংশ হিসেবে। ওই ব্যক্তিটি চাকরি না করলে তার মেধাকে অন্য জায়গায় ব্যয় করলে আরো বেশি সফল হতেন। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার এবং সাবেক জেলা জজ কবিতা খানম বলেন, বিচারপতিদের প্রাধিকার অ্যাক্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কমিশনারদের প্রাধিকার কী হবে। কিন্তু আমরা চাইছি, বিচার বিভাগের মতো নির্বাচন কমিশনও সাংবিধানিক ও স্বাধীন সত্তা। এ বিবেচনায় বিচারপতিদের আদলে কমিশনারদের জন্য স্বতন্ত্র প্রাধিকার অ্যাক্ট করার প্রাথমিক একটা খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এটিকে কীভাবে গ্রহণযোগ্য করে অ্যাক্ট করে স্বতন্ত্র রূপ দেওয়া যায়, তা নিয়ে একটি সাব-কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি এখনো প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়নি বলে আমার জানা আছে। তারা আলোচনা, পর্যালোচনা করে দেখুক এই উদ্যোগটি কতটুকু যৌক্তিক এবং কী সুপারিশ ও প্রস্তাবনা নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে দেয়, তার আলোকে কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এখনই এটা নিয়ে বলার মতো কিছু হয়নি। আরও পড়ুন: নির্বাচন কমিশন নখদন্তহীন বাঘ নয়, বিড়ালে পরিণত হবে তবে তাদের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, সাংবিধানিক পদে থাকার পর অবসরে যাওয়ার পর পেনশন সুবিধা চাওয়াটা যুক্তিসংগত বলে আমার কাছে মনে হয় না। কারণ চাকরিজীবীরা জীবনের মূল্যবান সময় (এনার্জি, মেধা) সরকারের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। তাদের মেধাকে সরকারের চাওয়া-পাওয়ার বাইরে কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল না। তাদের দীর্ঘ-কর্মজীবনের কাজের প্রাপ্তির অংশ হিসেবে সরকার সম্মান করে সিনিয়র সিটিজেন বিবেচনায় পেনশন বা অবসরকালীন ভাতা দেন এটা যৌক্তিক। অন্যদিকে কমিশনার পদে যারা নিয়োগ পান, তারাও সমাজের মেধা-যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সমাজের যেকোনো ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্মান করে সরকার তাদের সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেন স্বল্পসময়ের জন্য। এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য অনেক বড় সম্মান। এই স্বল্পসময়ের জন্য দায়িত্বে থাকার কারণে পেনশন সুবিধার জন্য স্বতন্ত্র প্রাধিকার অ্যাক্ট করা আদৌ যুক্তিসংগত বলে আমার মনে হয় না। তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, তখন আলোচনা করে মনে হয়েছিল এটার প্রস্তাব দেওয়া সমীচীন হবে না, পরে ওই অবস্থান থেকে আমরা সরে আসি। ইসির কর্মকর্তারা বলেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা কমিশন অবসরে যাওয়ার পর পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেয়েছিলেন। তাদের নির্ধারিত মেয়াদ পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হয় আবু সাঈদকে। তার অধীন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মো. শফিউর রহমান, মুন্সেফ আলী ও মোহাম্মদ আলী। তবে বিপত্তি ঘটে মুন্সেফ আলী ও মোহাম্মদ আলী বিচার বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা। তারা চাকরি জীবনে যে অবসরকালীন পেনশন সুবিধা পেয়ে আসছেন, সাংবিধানিক পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর দুটি অবস্থান থেকে পেনশন সুবিধা পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। এই অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংবিধানিক পদধারীদের (অবসরকালীন পেনশন) সুবিধা তৎকালীন সরকার বন্ধ করে দেয়। পেনশন সুবিধা আবার সরকারকে বিবেচনায় নিতে নির্বাচন কমিশনার মো. শফিউর রহমান কয়েক দফা আরজি করেও লাভ হয়নি। পরে বিষয়টি আদালতে গড়ালে মামলায় কমিশন হেরে যায়। এখন নতুন করে ইসি কমিশনাররা প্রাধিকার অ্যাক্ট করার উদ্যোগ নিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, বিচারপতিরা জুডিশিয়ারি হিসেবে বিচারিক কাজ করে থাকেন। তবে কো-সাব-জুডিশ কাজ করে থাকেন কমিশনাররা। নির্বাচন মামলার শুনানি, সীমানা-সংক্রান্ত মামলা ও ট্রাইব্যুনাল করে আপিল শুনানি করে থাকেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনাররা। এ ছাড়া ইসি সাংবিধানিক পদ। এখানে রাষ্ট্র চাইলে সুশীলসমাজের কিংবা সিনিয়র আইনজীবী ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির থেকে কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে পারেন। এখন যারা এসেছেন, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা। তবে আগামীতে সার্ভিস থেকেই সবাই এ পদে আসবেনএমন বাধ্যকতা নেই। যে ব্যক্তি কোনো সার্ভিসে ছিলেন না অথচ সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পেয়েছেন, অবসরের পর তারা পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। এসব সার্বিক দিক বিবেচনায় কমিশন স্বতন্ত্র অ্যাক্ট করার চিন্তা করেছে। কমিশন সূত্র বলছে, এই উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল প্রাণসংহারী করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগে গত মার্চে। সেখানে আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির সভাপতি নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের সভাপতিত্বে ২১ মার্চ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভায় দ্য চিফ ইলেকশন কমিশনার এবং ইলেকশন কমিশনার (সম্মানী ও প্রাধিকার) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ (অধ্যাদেশ নম্বর এলভিআই অব ১৯৮৩) বিলুপ্ত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের (সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধাদি) আইন, ২০২০ এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের (ছুটি, পেনশন ও প্রাধিকার) আইন, ২০২০ শীর্ষক দুটি স্বতন্ত্র আইনপ্রণয়নের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভার কার্যপত্রে বলা আছে, প্রস্তাবিত আইনে বিচারপতিদের যেসব সুবিধা রয়েছে তার বাইরে অনেক বিষয়, যা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের ইতোমধ্যে দেওয়া আছে, তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, পেনশন সুবিধার বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের মতো আইন সংযোজন করা, সিইসি-কমিশনারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের প্রাধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের কর্মকালে (টেনিউর) এবং অবসরের পর তিন বছর পর্যন্ত ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ রাখা, প্রতিমন্ত্রীদের প্রাপ্য অনুযায়ী জ্বালানি প্রাপ্যসহ দুটি গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকার রাখা, মোবাইল ফোন সেটের ক্রয় বাবদ অর্থপ্রাপ্তির প্রাধিকার আইন অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইন্টারন্যাশনাল রোমিংসহ বিল নির্বাচন কমিশন বহন করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের বাড়ির জন্য একজন কুক এবং মালী-নিরাপত্তার কর্মীর জন্য নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ তাদের বেতনের সঙ্গে উত্তোলনের প্রাধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ঢাকার বাইরে ভ্রমণের সময় সার্কিট হাউস এবং ভিআইপি কক্ষপ্রাপ্তির কর্মকাল শেষের তিন বছর পর্যন্ত প্রাধিকার রাখা, বাসায় বাংলাদেশের পতাকা বিধি অনুযায়ী উত্তোলনের সুযোগ আইনে রাখা, বাসার জন্য হোম সিকিউরিটি এবং বাসার নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, বাসায় সরকারি খরচে ল্যান্ডফোন সুবিধা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং অফিসে আসা-যাওয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণকালে গানম্যানসহ পুলিশ প্রোটেকশনপ্রাপ্তির প্রাধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করাসহ নানা বিষয়ে সভায় নীতি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ এন এইচ, ২৫ আগস্ট
https://ift.tt/3jeIPrk
0 Comments