https://ift.tt/eA8V8J
ঢাকা, ০৫ জুলাই- পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বীমা কোম্পানি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এক ব্যক্তি। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ- আইডিআরএ। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রামাণও মেলে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ না করে উল্টো অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে আইডিআরএ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বীমা খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একটা কোম্পানিতে অনিয়ম হলে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কিছুতেই তার দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু ফারইষ্ট লাইফের অনিয়মের জন্য সিইওর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়নি আইডিআরএর প্রতিবেদনে। এটা বিস্ময়কর। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন আচরণ বীমা খাতে দুর্নীতি ছড়াতে উৎসাহিত করবে। আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনে কী কারণে কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশন-কে (দুদক) এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত, মন্তব্য তাদের। আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হলে একাধিক বীমা কোম্পানির সিইও বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের সিইও হেমায়েত উল্লাহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আবার একই বিষয়ে বলেছেন, সাবেক পরিচালক এম এ খালেক একক আধিপত্য বিস্তার করতেন। তার এ ধরনের বক্তব্য রহস্যজনক। আবু হেনা মোস্তফা কামাল নামের এক ব্যক্তি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে গত বছরের জুলাই মাসে অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করতে আইডিআরএ ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হেমায়েত উল্লাহর বক্তব্য নেন। হেমায়েত উল্লাহ তার বক্তব্যে কোম্পানির অনিয়মের ক্ষেত্রে সাবেক পরিচালক এম এ খালেক-কে দায়ী করেন। কিছু কিছু অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। আইডিআরএর তদন্ত কমিটি এম এ খালেকের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আইডিআরএ তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইষ্ট টাওয়ার ভবনটি নির্মাণের সময় কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইওর প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে অফিস স্পেস বিক্রির সময় কারসাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। ফারইষ্ট টাওয়ার-২ ভবনটি ক্রয়ের সময় প্রকৃত মূল্যের চেয়েও প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে ফারইষ্টের সিইও জানান, যেকোনো ধরনের সম্পদ পরিচালনাপর্ষদ ও পারচেজ কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর পর্ষদ-সভায় বিক্রেতার উপস্থিতিতে প্রকৃত দর নির্ধারণ করা হয়। সেই সঙ্গে আইডিআরএর চাহিদা অনুযায়ী সার্ভে রিপোর্টসহ আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র জমা দিয়ে আইডিআরএর অনুমতিসাপেক্ষে ক্রয় করা হয়। তবে সকল বোর্ড সভায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেক একক আধিপত্য বিস্তার করতেন। তার সিদ্ধান্ত বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হতো। সেখানে কোম্পানির চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো কর্মকর্তার পক্ষে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। রাজধানীর গুলশান-২ এবং গোড়ান চাটবাড়ি এলাকায় প্লট কেনার নামে ১৬০ কোটি (৬০+১০০) টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও উত্থাপিত হয়। কিন্তু এটিও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে জানান ফারইষ্ট লাইফের সিইও। এছাড়া বিভিন্ন জেলা শহরে প্লট ও অফিস কেনার নামে কোটি কোটি টাকা হাতি নেয়ার অভিযোগ এবং অন্যান্য খাতগুলোতে বিনিয়োগ না করে আবাসন খাতে বিনিয়োগ বেশি করার বিষয়ে ফারইষ্ট লাইফের সিইও কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেকের ওপরই দোষ চাপান। এছাড়া কোম্পানির নিজস্ব সফটওয়্যার ও কম্পিউটার কেনার সময় ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে ১৫ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়া সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে হেমায়েত উল্লাহ জানান, বোর্ড সভার পরিচালকদের উপস্থিতিতে সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে দর নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়া হয়। এসব ব্যয়ের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেকের একক আধিপত্য থাকত। কোম্পানির লাইফ ফান্ডের বড় একটি অংশ পছন্দের কিছু ব্যাংকে বিনিয়োগ করে কমিশন গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে হেমায়েত উল্লাহ বলেন, এফডিআর করার আগে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মুনাফা দেয়া ব্যাংকের তালিকা করে বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। বোর্ড সভার পরিচালকদের অনুমোদন দেয়া ব্যাংকে এফডিআর করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তির পক্ষে কমিশন গ্রহণের সুযোগ নেই। গাড়ি ক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ব্যয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গাড়ি কেনার বিষয়েও বোর্ড সভার অনুমোদন নেয়া হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর টেন্ডার আবেদন করে গাড়ি কেনা হয়। এসব ক্ষেত্রে এম এ খালেকের আধিপত্য ছিল। অপর এক অভিযোগের বিষয়ে ফারইষ্টের সিইও বলেন, নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান হলেও সকল ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেকের হাতে ছিল, যা সবাই অবগত। বোর্ড ও ম্যানেজমেন্ট কমিটির মধ্যে এম এ খালেকের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টের সদস্য দ্বিমত পোষণ করলে তাকে চরমভাবে অপমানিত করা হতো এবং পরিচালনাপর্ষদ থেকে বের করে দেয়ার হুমকিও দেয়া হতো। অনেককে তিনি বেরও করে দিতেন। এম এ খালেক কোম্পানির সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন। তার উচ্চ স্বরের কাছে সবাই চুপ থাকতে বাধ্য হতেন। তিনি ছিলেন কোম্পানির ত্রাস সৃষ্টিকারী ক্ষমতাধর এক পরিচালক। হেমায়েত উল্লাহ আরও বলেন, কোম্পানির এএমডি ও সিএফও আব্দুল খালেক, অডিট ইনচার্জ মো. কামাল হোসেন হাওলাদার এবং ডিএমডি ও কোম্পানি সচিব আব্দুল আজিজ তার (এম এ খালেক) নিজ এলাকার। ডিএমডি ও প্রশাসনের প্রধান হেমায়েত উদ্দিন তার আপন ছোট ভাই। এম এ খালেক মানব সম্পদ বিভাগের ইনচার্জ নিলুফার ইয়াসমিনের বাসায় টিউটর হিসেবে তার বড় বোনকে পড়াতেন। ফারইষ্ট লাইফের সিইও বলেন, কোম্পানির অনেক সম্পত্তি এম এ খালেক তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে আর্থিক সুবিধা ভোগ করতেন। ফারইষ্ট টাওয়ার- ১ এর দুটি ফ্লোর, ফারইষ্ট টাওয়ার- ২ এর দুটি ফ্লোর, গোড়ান চাটবাড়ি জমিতে ঘর করা, গবাদি পশুপালন, ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের ২.৫ বিঘা জমিতে প্রাইম প্যাকেজিং কারখানার জন্য কোনো টাকা ছাড়াই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নেন। পরবর্তীতে তা ফেরত নেয়া হয়। এদিকে ফারইষ্ট লাইফের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম আইডিআরএ তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, এম এ খালেক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলন। তার নির্দেশনা, একক আধিপত্য এবং একক সিদ্ধান্তে বিগত ১৮ বছর কোম্পানি পরিচালিত হয়েছে। তার একক সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানি বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীতে বোর্ড সভার সদস্য ও ম্যানেজমেন্টের চাপে তিনি তার বিগত বছরের কর্মকাণ্ডের দায় স্বীকার করে প্রথম ধাপে তার ব্যক্তিগত সম্পদ বিভিন্ন ফরমেটে কোম্পানির নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে হস্তান্তর করেন, যার মূল্য ৩৭৬ কোটি টাকা। আইডিআরএ তদন্ত দল এম এ খালেক এবং অভিযোগকারীর বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেও তা নিতে পারেননি উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ফারইষ্ট লাইফের প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় প্রভাব বিস্তার করতেন এবং ইচ্ছামতো তা পরিচালনার চেষ্টা করতেন। এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, এম এ খালেক যতই অনৈতিক কাজ ও প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করুক না কেন, ফারইষ্ট লাইফের মতো বৃহৎ কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সিইও হেমায়েত উল্লাহ এবং বোর্ডের অন্য সদস্যরা এসব ব্যাপারে কঠোর ও শক্ত অবস্থান নিতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবিকতার কারণে তারা হয়তো ঝুঁকি নেননি। এছাড়া বিষয়টির সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আইডিআরএ-কে লিখিতভাবে জানানো যেত। আইডিআরএর তদন্ত কমিটির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়েছে, এম এ খালেক তার বিগত দিনের কার্যকলাপের দায় স্বীকার করে ৩৭৬ কোটি টাকার সম্পত্তি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নিকট হস্তান্তর করেছেন এবং অবশিষ্ট দায় হস্তান্তরের বিষয়ে কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছেন। তদন্ত টিম হস্তান্তর করা কিছু সম্পত্তি পরিদর্শন করেছে এবং কাগজপত্র যাচাই করে হস্তান্তরের বিষয়ে প্রমাণ পান। এম এ খালেকের জবানবন্দি নেয়াটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু তিনি ব্যক্তব্য দেননি। আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ- ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ বিবেচনা করে সতর্কতার সঙ্গে প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। ব্যবস্থাপনা ব্যয় ন্যূনতম সময়ের মধ্যে কমিয়ে আনার জন্য ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। সরকারি বন্ডের বিনিয়োগ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ৩০ শতাংশ অতিশিগগির পূর্ণ করার জন্য ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। অতি জরুরি ভিত্তিতে এম এ খালেকের নিকট থেকে বাকি সম্পত্তি/অর্থ ফেরত এনে তা পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের এখতিয়ারে আনার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের সিইও হেমায়েত উল্লাহকে তার দায়িত্ব পালনে ক্ষেত্রে আর গতিশীল ও যত্নবান হওয়ার জন্য সতর্ক করা যেতে পারে। অভিযোগকারী মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল উস্কানিমূলক লিখিত অভিযোগ দেয়ায় এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে অযাচিতভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সার্বিক বিষয়ে আইডিআরএ জীবন বীমা সংক্রান্ত সদস্য ড. এম. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যখন একটি কোম্পানিতে অনিয়ম হয়, তখন সিইও কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের গেটওয়ে। একটা প্রতিষ্ঠান থেকে যখন অন্যায়ভাবে অর্থ বেরিয়ে যায়, এটা সিইওর নলেজ ছাড়া বের হতে পারে না। তিনি বলেন, এটা পাবলিক মানি। এখানে কম্প্রোমাইজের কোনো সুযোগ নেই। আমাকে (সিইও) যদি কেউ জোর করে, আমি রিজাইন দিয়ে চলে আসব, এটা সহজ কথা। যা-ই হোক, আমরা বিষয়টি দেখছি। আমাদের তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে এটাই চূড়ান্ত নয়। এটা নিয়ে আরও কাজ হচ্ছে। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের সিইও হেমায়েত উল্লাহর সঙ্গে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এম এন / ০৫ জুলাই
https://ift.tt/2Z11KPu
0 Comments