https://ift.tt/eA8V8J
সিলেট, ২৪ জুলাই- তিনি জাদুকর ঠিকাদার। তিন বছরে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৬৪টি সরকারি প্রকল্পের কার্যাদেশ একাই পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠান আক্তার ট্রেডার্স। গণপূর্ত বিভাগ, এলজিইডি, সওজ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর- এই পাঁচ দপ্তরে তার প্রতিষ্ঠানের বিশেষ আধিপত্য। নানা যোগসাজশে পাওয়া শতকোটি টাকার এসব প্রকল্পের বেশিরভাই আবার তিনি বিক্রি করে দেন সাব-ঠিকাদারের কাছে। কাগজ কারসাজির মাধ্যমে ঘরে বসে কমিশন পান কোটি কোটি টাকা। এতেও মন ভরেনি। প্রকল্পের পুরো টাকা হস্তগত করতে সম্প্রতি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে সাব-ঠিকাদারদের অর্থ উত্তোলনের অথরাইজেশন বাতিল করে দেন তিনি। এতে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলা ঠিকাদাররা পড়েন মহাফাঁপড়ে। সিলেটে এমন অন্তত ১৭ জন ঠিকাদার একদিকে টাকার মায়া, অন্যদিকে পরিবারের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় কখনো আদালত, কখনো প্রশাসন, কখনো গণমাধ্যমকর্মীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। অনিশ্চয়তা আর হুমকি-ধমকির ভয়ে অনেকে হাল ছেড়েছেন, অনেকে দেশও ছেড়েছেন। কিন্তু বহাল তবিয়তে আছেন ২ দুর্নীতি ও ১০ প্রতারণা মামলার আসামি সেই ঠিকাদার। সাব-ঠিকাদারদের কাজের টাকার হিসাব নিজের নামে দাখিল করে তিনবার সেরা আয়কর দাতাও হয়েছেন তিনি। তার কারসাজিতে যেমন দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে বিভিন্ন প্রকল্প, তেমনি কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা প্রকল্পগুলোর টাকা পুরোটাই মেরে দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন তিনি। তার এসব কাজের প্রতিবাদ করায় নিজের দীর্ঘদিনের ম্যানেজার হাফিজুল হক মাসুককেও মামলায় ফাঁসিয়েছেন তিনি। কারসাজির জাদুকর এই ঠিকাদারের নাম জামাল আহমদ চৌধুরী। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার খলাদাপনিয়া গ্রামের আবদুল মোমিন চৌধুরীর ছেলে জামাল আহমদ চৌধুরীর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে প্রতারণার বিষয়টি। ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঠিকাদারদের করা মামলায় একবার জেলে গেলেও পাওনা টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সমঝোতা করে জামিনে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে প্রতিশ্রুতি তো রাখেনইনি, উল্টো এখন ঠিকাদারদের জালিয়াত দাবি করছেন তিনি। টাকা না পেয়ে অন্য ঠিকাদাররা আবার মামলা করলেও অদৃশ্য খুঁটির জোরে বহাল আছেন জামাল আহমদ। যত অভিযোগ : জামাল আহমদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ নতুন নয়। ঠিকাদারির শুরু থেকেই তার প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দরিদ্র অবস্থা থেকে টাকার কুমির বনে যাওয়া জামাল আহমদ চৌধুরীর উত্থান পলাতক ও বিতর্কিত বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর আনুকূল্যে। বিএনপি আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর প্রভাবে সিলেট বিভাগে সরকারি দপ্তরের বেশিরভাগ প্রকল্প নামে-বেনামে বাগিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি। অন্তত ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্যাড বানিয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৯০ ভাগ কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। বিএনপি আমল থেকেই কৌশলে সরকারি দপ্তরের কাজ বাগিয়ে নিলেও নিজে কোনো কাজ করেন না তিনি। ২০১৫ সাল থেকে আইনবহির্ভূতভাবে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অন্যের কাছে প্রকল্পের কাজ বিক্রি করেই আয় করেন কোটি কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সিলেট গণপূর্ত বিভাগের অধীনে আটটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মৌলভীবাজার এলজিইডির দুটি ও গণপূর্ত বিভাগের তিনটি, সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নয়টি ও এলজিইডির অধীনে একটি প্রকল্পের কাজ পায় তার প্রতিষ্ঠান আক্তার ট্রেডার্স। এই ২৩টি প্রকল্প হাতবদল করেই প্রায় ২০ কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন জামাল আহমদ। এই টাকার কোনো করও দেননি তিনি। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে জামাল আহমদ তার কাছ থেকে প্রকল্প কেনা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বাতিল করেন আর্থিক অথরাইজেশনও। ফলে সাব-ঠিকাদাররা নিজেদের টাকায় কাজ করলেও সরকারি বিল জমা হয় আক্তার ট্রেডার্সের ব্যাংক হিসাবে। সিলেট গণপূর্ত বিভাগের অধীনে আটটি প্রকল্পের মধ্যে চারটির চুক্তিমূল্য ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। কার্যাদেশ পাওয়া আক্তার ট্রেডার্সের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে এখন প্রকল্পগুলোর কাজ করেছে ঢালী কনস্ট্রাকশন। মৌলভীবাজার এলজিইডির একটি ও সুনামগঞ্জ গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুটি প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ১২ কোটি টাকা। আক্তার ট্রেডার্সের কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় এ তিনটি প্রকল্পের কাজ কিনেছেন ফরিদ আহমদ নামের এক ঠিকাদার। সুনামগঞ্জ গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১১ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প আক্তার ট্রেডার্সের কাছ থেকে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ঠিকাদার দিব্যদূতি দাশ। সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ এলজিইডির তিনটি এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার গণপূর্ত অধিদপ্তরের ছয়টি প্রকল্প কেনেন ঠিকাদার সিদ্দিক হোসেন। এই নয়টি প্রকল্পের জন্য তিনি আক্তার ট্রেডার্সকে দেন................। সুনামগঞ্জ গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে দোয়ারাবাজার মডেল থানা ভবন নির্মাণের ৭ কোটি টাকার প্রকল্পটি আক্তার ট্রেডার্সের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকায় কিনেছেন ঠিকাদার দারুল ইসলাম ও তেরাব আলী। মৌলভীবাজার গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে মুন্সীবাজার ভূমি কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ৫৭ লাখ ২৫ হাজার ৫১৩ টাকা। আর বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণের কাজটি ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার। দুটি কাজই কিনেছেন ঠিকাদার বাবুল মিয়া। এ জন্য তিনি ৩৯ লাখ টাকা আক্তার ট্রেডার্সকে দিয়েছেন। সিলেট গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে আরও তিনটি প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় আক্তার ট্রেডার্স। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর প্রকল্পগুলো আবুল কালাম আজাদ নামের এক ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে জামাল আহমদ পেয়েছেন ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। আরও পড়ুন:বাসের হেলপার থেকে কোটিপতি ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ আছে এসব কাজ পাওয়া ও জালিয়াতির কাজে জামাল আহমদ চৌধুরীকে সহযোগিতা করেন কয়েক জন সরকারি কর্মকর্তা। এসব অভিযোগে সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে স্ট্যান্ড রিলিজও হতে হয়। বিএনপি সরকারের পর ওয়ান-ইলেভেনে জামাল আহমদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৬টি দুর্নীতি মামলা হয়। তখন গা-ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। টাকা ছড়িয়ে আর বিভিন্ন দপ্তরের পুরনো সম্পর্কের সূত্র ধরে চলতে থাকে তার জালিয়াতি। বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার সঙ্গে সিলেট ও সিলেটের বাইরে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। সরকার শুদ্ধি অভিযান শুরু করলে আবার গা-ঢাকা দেন তিনি। এরই মধ্যে কাজ শেষ হওয়া প্রকল্পের টাকা জামাল আহমদ চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ায় সেই টাকাও পাচ্ছেন না সাব-ঠিকাদাররা। ঠিকাদারদের হাহাকার : জামাল চৌধুরীর জালিয়াতিতে পড়ে এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে দিব্যদূতি দাস, উত্তম কুমার সরকার, রিপন আহমদ, কবির আহমদ, কামরুল ইসলাম, সিদ্দিক হোসেন, সেলিম আহমদ, বাবলু মিয়া, ফরিদ আহমদ, তেরাব আলী, লুৎফুর রহমান খান, মো. শাহজাহান ও আবুল কালাম আজাদসহ আরও অনেক ঠিকাদার। তাদের মধ্যে ফরিদ আহমদ, বাবলু মিয়া, তেরাব আলীসহ কয়েক জন জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৭টি প্রতারণা মামলা করেন গত বছরই। মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে সমঝোতা করে দুটি মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়ে গা-ঢাকা দিলে ধারের দেনা এবং হুমকির মুখে নিখোঁজ থাকা দিব্যদূতি দাসের স্ত্রী কণা রানী দাস, ঠিকাদার দারুল ইসললাম দারা এবং একে আজাদ আরও তিনটি প্রতারণা মামলা করেন। এসব মামলায় অগ্রগতি না থাকা, আর ধার করে প্রকল্পের কাজ তুলে দেওয়ার পর পাওনাদারদের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যান অনেক ঠিকাদারও। এ বিষয়ে কথা হলে ঠিকাদার সিদ্দিক হোসেন বলেন, জামানত ও প্রকল্পের কাজের বিলের টাকা পেতে সিলেট এয়ারপোর্ট থানার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। জামাল আহমদ নাকি পুলিশের কথাও শুনছে না। পুলিশ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকবে না। ঠিকাদার একে আজাদ বলেন, সমঝোতার জালিয়াতি করে জামিনে বেরিয়ে এসে আসল চেহারা দেখিয়েছেন জামাল আহমদ। জামানত, কমিশন, কাজের টাকা সবই আত্মসাৎ করেছেন। একাধিক মামলা করেও কোনো ফল পাচ্ছি না। আমরা দিশেহারা হয়ে গেছি। নিখোঁজ থাকা ঠিকাদার দিব্যদূতি দাসের স্ত্রী কণা রানী দাস কান্নাকণ্ঠে বলেন, জামাল আহমদের প্রতারণায় পড়ে আমার স্বামী নিখোঁজ। সমাজে কীভাবে এমন মানুষ টিকে থাকে জানি না। ঠিকাদার মো. শাহজাহান বলেন, জামাল আহমদ চৌধুরীকে ২০ লাখ দিয়ে আমি গোয়াইনঘাট উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণের ৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার কাজ নিই। সে জন্য জামানত জমা দিতে হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা, যা কাজ শেষ হলে পাওয়ার কথা। কিন্তু কাজের শেষপর্যায়ে গিয়ে তিনি অথরাইজেশন বাতিল করে দিয়েছেন। এখন সব মিলিয়ে আমার প্রায় ১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে চাইছেন তিনি। এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিম বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবেই বিএনপি সরকারের আমলে শিক্ষা প্রকৌশলের বেশিরভাগ টেন্ডার পেত জামাল আহমদ চৌধুরীর নামে-বেনামের প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এখন তার নিজের নামে কোনো কাজ নেই। আর্থিক অথরাইজেশন বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে এলজিইডি সুনামগঞ্জ জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকবাল আহমদ বলেন, তাদের মধ্যে ঝামেলা আছে বলে শুনেছি। এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, উপজেলা অফিসে এ রকম একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। আমার কাছে এখনো আসেনি। তবে প্রতিনিধির সাথে ঠিকাদারের আর্থিক ঝামেলা আছে বলে জানি। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে জামাল আহমদ চৌধুরী দাবি করেন, আমার প্রতিষ্ঠানের সুনামের কারণেই আমি কাজ পেয়েছি। ঠিকাদাররা স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এসব চুক্তি করেছে। তাদের মামলাও মিথ্যা। তা হলে সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে অথরাইজেশন বাতিল করতে হলো কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা সবাই মিলে সিন্ডিকেট করে আমাকে পথে বসানোর ষড়যন্ত্র করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র: আমাদের সময় আর/০৮:১৪/২৪ জুলাই
https://ift.tt/2ZSLtfH
0 Comments