https://ift.tt/eA8V8J
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন ক্লাস নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে শুরু করা এ ক্লাসের বাইরেই থাকছে উচ্চশিক্ষা স্তরের অন্তত ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের প্রস্তুতিহীনতা, জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের জুম প্ল্যাটফর্মে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকা, শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতি, সব শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন না থাকা এবং দূরবর্তী জেলা ও দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের ধীর গতি এসব ক্লাসের জন্য ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কোনো কোনো এলাকায় ক্লাস চলাকালীন বিদ্যুতের লোডশেডিংও শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে গত মাস পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে ছিল দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস আরও দুমাস আগেই শুরু হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হয়নি। করোনা সংক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হলগুলো খালি করে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। তারা এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চাপে অনেকটা বাধ্য হয়েই গত ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আংশিক অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে এসব ক্লাসে অংশগ্রহণের হার আশানুরূপ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে অনলাইন ক্লাস শুরু করা হয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন পুনরুদ্ধার করার জন্য আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালু করা একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে। তবে অপরিকল্পিত, অপ্রস্তুত ও বৈষম্যমূলক পন্থায় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তা চালুর চেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আত্মঘাতী হবে। ক্লাস শুরুর আগে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের বাস্তব অসুবিধার কথা বিবেচনা করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে আমরা এই ক্লাস শুরুর আগেই সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে দিয়েছি। তারা হয়তো এটি নিয়ে কাজ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বখতিয়ার আহমেদ বলেন, মহামারির কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বাড়ি ফিরে গেছে, উপযুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের নতুন করে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কেনার সামর্থ্য নেই। প্রস্তুতি ছাড়া ক্লাস শুরু হয়েছে, এখন যত দ্রুত সম্ভব সমতা বিধানের জন্য শতভাগ শিক্ষার্থীকে সহায়তা দিতে হবে। ঢাবি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক বিভাগ থাকলেও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে ৭০টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চালানো এক জরিপে এ তথ্য মিলেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, প্রায় সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেই অনলাইন ক্লাস চলছে। করোনা মহামারিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে অনলাইন ক্লাস নিতে বিভাগগুলোকে অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও মার্চের শেষের দিকে হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগে অনলাইন ক্লাস চালু হয়। গত ২৫ জুন ঢাবির অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনার অগ্রগতি পর্যালোচনা শীর্ষক সভা থেকে এই অনুরোধ করা হয়। জানা গেছে, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণ ও আর্থিক সংশ্নেষসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রো-উপাচার্যকে (শিক্ষা) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, কমবেশি সব বিভাগই অনলাইন ক্লাসে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন অনুষদের ডিনরা সবসময় আমাকে এ বিষয়ে জানাচ্ছেন। সব শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী ভাবছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। জাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জুলাই থেকে অধিকাংশ বিভাগ অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। তবে উপস্থিতির ওপর কোনো নম্বর ও কোনো ধরনের পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যেসব শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে এবং যাদের পরীক্ষার ফল এখনও প্রকাশ করা হয়নি, তারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। ৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে বিভিন্ন বিভাগের সভাপতি, অনুষদের ডিন ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকদের অংশগ্রহণে এক অনলাইন বৈঠকে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন বলেন, প্রায় অধিকাংশ বিভাগই প্রাথমিকভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে। তবে কোনো ধরনের পরীক্ষা বা টিউটোরিয়াল নেওয়া হবে না। শিক্ষকরা চাইলে অ্যাসাইনমেন্ট দিতে পারবেন। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা শেষ করতে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে ক্লাস বিষয়ে গণিত ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদারকে প্রধান করে একটি টেকনিক্যাল কমিটি হয়েছে। ক্লাস পরিচালনায় শিক্ষকরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে এ কমিটিকে অবহিত করবেন। এদিকে, অনেক শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়নি। আটকে আছে অন্য শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষাও। এ বিষয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের চতুর্থ বর্ষের কোর্স মোটামুটি শেষ। অথচ এখনও তারা তৃতীয় বর্ষের ফল পাননি। ফলে আটকে আছে অন্য শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। রাবি : অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও (রাবি)। ৯ জুলাই থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করে রাবি। ক্লাস শুরুর কয়েক দিন পার হলেও এখনও সেভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংযুক্তি বাড়েনি বলে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এজন্য তারা প্রশাসনের হঠাৎ সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন। তবে প্রশাসন বলছে, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংযুক্তি বাড়াতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপাচার্য ঘোষণা দেন, ৯ জুলাই অনলাইন ক্লাস শুরু হবে। পরদিন অনুষদের ডিন ও ইনস্টিটিউট পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করেন উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। ৮ জুলাই বিভাগের সভাপতিদের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনা করেন উপাচার্য। পরের দিনই শুরু হয় ক্লাস। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংযুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে অনলাইন ক্লাস মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক বাবুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটই অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়েছে। এখনও সব শিক্ষক ক্লাসে যুক্ত হননি; তবে কমবেশি সব বিভাগ-ইনস্টিটিউটের শিক্ষকই যুক্ত হয়েছেন। উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান বলেন, অনলাইন কখনও ক্লাস টিচিংয়ের বিকল্প হতে পারে না। এ মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় যুক্ত করতে কোনো পথ ছিল না। ক্লাসে শতভাগ উপস্থিত নিশ্চিত করা সম্ভব না। নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, টেকনিক্যাল ডিভাইস সমস্যাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে; শিক্ষকদের প্রস্তুতির বিষয়ও রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংযুক্তি যতটা বাড়ানো যায়। শিক্ষার্থীদের খরচ কমাতে প্রশাসনের কোনো আর্থিক সহযোগিতা থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাবিতে প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী; এই বৃহৎ শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব না। চবি : করোনা আক্রান্ত উপাচার্য সুস্থ হয়ে উঠলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান। তিনি বলেন, আমরা অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের শিক্ষকরাও অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রস্তুত আছেন। ইউজিসির বক্তব্য : ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই হয়তো অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে, কারণ আমরা চাইনি শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ২০২০ সাল কেড়ে নিতে। ক্লাস শুরুর আগে আমরা জরিপ চালিয়ে যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেছি, তা সমাধান করতে অনুরোধ করে সংশ্নিষ্ট চারটি মন্ত্রণালয়কে ইউজিসি থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইন্টারনেটের স্লো স্পিড, লোডশেডিংসহ আরও কিছু বাস্তব সমস্যা আছে। আর স্মার্টফোন কিনতে অতিদরিদ্র শিক্ষার্থীদের আবেদন বিবেচনা করতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বলেছি। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবহন খরচ, আপ্যায়ন খরচসহ কিছু খরচ কমেছে। সেসব খরচের টাকা দিয়ে এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ তহবিলের অর্থ দিয়েও তাদের সহায়তা করা যাবে। তবে জেনুইনলি যারা অতিদরিদ্র তাদেরই কেবল সহায়তা করতে বলা হয়েছে। সবাইকে ঢালাওভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। ইউজিসির বাজেটেও করোনার খাতে তিন কোটির কিছু বেশি টাকা রাখা হয়েছে। সেখান থেকেও প্রয়োজন হলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহায়তা দিতে পারব। এম এন / ১৯ জুলাই
https://ift.tt/32wNDn5
0 Comments